রাতের গভীর নিস্তব্ধতা যখন চরাচর জুড়ে নেমে আসে, যখন পৃথিবীর প্রায় সব প্রাণীকুল ঘুমে বিভোর, তখন আল্লাহর কিছু প্রিয় বান্দা জেগে ওঠেন শুধুমাত্র তাঁর সাথে একান্তে কথা বলার জন্য। এই গভীর রাতের প্রার্থনা বা নামাজই হলো ‘সালাতুত তাহাজ্জুদ’—বান্দার সাথে আল্লাহর সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনের এক বিশেষ মুহূর্ত।
যদিও তাহাজ্জুদ নামাজ ফরজ নয়, কিন্তু নফল ইবাদতগুলোর মধ্যে এটিই সর্বশ্রেষ্ঠ। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনো তাহাজ্জুদ ত্যাগ করেননি। এই নামাজ আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক পরীক্ষিত মাধ্যম।
এই সম্পূর্ণ গাইডে আমরা তাহাজ্জুদ নামাজ কী, এর সময়, রাকাত সংখ্যা, নিয়ম এবং অতুলনীয় ফজিলত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
তাহাজ্জুদ নামাজ কী?
আরবি ‘তাহাজ্জুদ’ শব্দের অর্থ হলো ‘রাত জাগা’ বা ‘নিদ্রা ত্যাগ করে ওঠা’। ইসলামি পরিভাষায়, এশার নামাজের পর ঘুমিয়ে, মধ্যরাতে ঘুম থেকে জেগে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে নফল নামাজ আদায় করা হয়, তাকেই ‘তাহাজ্জুদ নামাজ’ বলে।
তাহাজ্জুদ নামাজের সময়: কখন পড়া উত্তম?
তাহাজ্জুদের সময় শুরু হয় এশার নামাজের পর থেকে এবং শেষ হয় সুবহে সাদিকের আগে। তবে সবচেয়ে উত্তম সময় হলো রাতের শেষ তৃতীয়াংশ।
সর্বোত্তম সময়: রাতের শেষ তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ সুবহে সাদিকের আগের সময়টুকু।
আল্লাহর বিশেষ আহ্বান: এই সময়ে মহান আল্লাহ দুনিয়ার নিকটবর্তী আকাশে নেমে আসেন এবং বান্দাদের আহ্বান করতে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“আমাদের রব প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন: কে আছে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব? কে আছে আমার কাছে চাইবে, আমি তাকে তা দান করব? কে আছে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব?” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩২১)
বিশেষ ছাড়: যদি কেউ রাতের শেষ ভাগে ঘুম থেকে উঠতে পারার ব্যাপারে নিশ্চিত না হন, তবে তিনি এশার নামাজের পর এবং বিতর নামাজের আগে তাহাজ্জুদ আদায় করে নিতে পারেন। তবে দেরিতে পড়া বেশি সওয়াবের।
তাহাজ্জুদ নামাজ কত রাকাত?
তাহাজ্জুদ নামাজের রাকাত সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়।
** সর্বনিম্ন:** ২ রাকাত।
রাসূল (সা.)-এর আমল: তিনি সাধারণত ৮ রাকাত তাহাজ্জুদ পড়তেন এবং এরপর ৩ রাকাত বিতর পড়তেন। তবে তিনি কখনো ৪ বা ১২ রাকাতও পড়েছেন।
নতুনদের জন্য ২ রাকাত দিয়ে শুরু করাই উত্তম। মূল বিষয় হলো একনিষ্ঠতা ও ধারাবাহিকতা।
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম (ধাপে ধাপে)
তাহাজ্জুদের নামাজ অন্য যেকোনো নফল নামাজের মতোই। নিচে একটি সহজ গাইড দেওয়া হলো:
১. নিয়ত করা
গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে নামাজের জন্য দাঁড়ালে আপনার হৃদয়ের ইচ্ছাই নিয়তের জন্য যথেষ্ট। মুখে উচ্চারণ করা জরুরি নয়। তবুও কেউ যদি আরবিতে নিয়ত করতে চান, তবে বলতে পারেন:
“নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তা'আলা রাক'আতাই সালাতিত তাহাজ্জুদি, সুন্নাতু রাসূলিল্লাহি তা'আলা, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা'বাতিশ শারিফাতি, আল্লাহু আকবার।”
২. নামাজ আদায়
দুই রাকাত করে নামাজ আদায় করা উত্তম।
তাকবিরে তাহরিমা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নামাজ শুরু করুন।
সানা পড়ুন।
সূরা ফাতিহার সাথে পবিত্র কুরআনের যেকোনো সূরা বা আয়াত যা আপনার মুখস্থ আছে, তা তিলাওয়াত করুন। তাহাজ্জুদে দীর্ঘ ক্বিরাত বা তিলাওয়াত করা অত্যন্ত সওয়াবের।
এরপর স্বাভাবিক নামাজের মতোই রুকু ও সিজদা করুন।
দ্বিতীয় রাকাতে তাশাহহুদ, দরুদ শরিফ ও দোয়া মাসুরা পড়ে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করুন।
এভাবে আপনি আপনার ইচ্ছা ও সামর্থ্য অনুযায়ী দুই দুই রাকাত করে নামাজ পড়তে পারেন।
৩. দোয়া করা
নামাজ শেষে কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। এই সময় দোয়া কবুলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। নিজের প্রয়োজন, গুনাহ মাফ এবং দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের জন্য কাঁদুন।
তাহাজ্জুদ নামাজের অতুলনীয় ফজিলত
আল্লাহর নৈকট্য লাভ: এটি আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে প্রিয় ইবাদতগুলোর একটি।
দোয়া কবুল: এই সময়ে করা দোয়া আল্লাহ ফিরিয়ে দেন না।
গুনাহ মাফ: তাহাজ্জুদ বান্দার গুনাহ মাফ করিয়ে দেয় এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা করে।
আত্মিক প্রশান্তি: এই নামাজ অন্তরে গভীর প্রশান্তি এনে দেয় এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ককে মজবুত করে।
রাসূল (সা.)-এর সুন্নত: এটি প্রিয় নবী (সা.)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত, যা পালনের মাধ্যমে তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পায়।
একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ
রাসূলুল্লাহ (সা.) শুধু নিজেই তাহাজ্জুদ পড়তেন না, পরিবারের সদস্যদেরও উৎসাহিত করতেন। তিনি বলেন: “আল্লাহ ওই ব্যক্তির ওপর রহমত নাজিল করেন, যিনি রাতে জেগে তাহাজ্জুদ পড়েন এবং তাঁর স্ত্রীকে জাগিয়ে দেন। যদি স্ত্রী উঠতে না চান, তবে তাঁর মুখে আলতো করে পানির ছিটা দেন।” (আবু দাউদ, হাদিস: ১৩০৮)
তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, তাহাজ্জুদ পড়তে গিয়ে যেন ফজরের ফরজ নামাজ ছুটে না যায়। কারণ, ফরজের গুরুত্ব নফলের চেয়ে অনেক অনেক বেশি।
Comments
Post a Comment