রাতের নিস্তব্ধতা মুমিন নারীর জন্য এক বিশেষ উপহার। যখন দুনিয়ার সব কোলাহল থেমে যায়, তখন মহান আল্লাহর সাথে একান্তে কথা বলার, নিজের দুঃখ-কষ্ট পেশ করার এবং হৃদয়ের গভীর থেকে দোয়া করার এক সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়। আর এই সুযোগের সবচেয়ে সুন্দর রূপ হলো ‘সালাতুত তাহাজ্জুদ’।
অনেক বোনেরাই তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতে আগ্রহী হন, কিন্তু এর নিয়ম বা মহিলাদের জন্য বিশেষ কোনো বিধান আছে কিনা, তা নিয়ে দ্বিধায় ভোগেন। এই পূর্ণাঙ্গ গাইডটি বিশেষভাবে আমাদের মা ও বোনদের জন্য তৈরি করা হয়েছে, যেখানে সব প্রশ্নের সহজ সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
পুরুষ ও মহিলাদের তাহাজ্জুদ কি ভিন্ন?
প্রথমেই একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন—তাহাজ্জুদ নামাজের মূল নিয়ম, রাকাত সংখ্যা বা পঠিতব্য দোয়ার ক্ষেত্রে পুরুষ ও মহিলার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধু পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে। যেমন:
জামাত: পুরুষদের জন্য মসজিদে জামাতে নামাজ আদায়ের فضیلت থাকলেও, মহিলাদের জন্য নিজ ঘরে ইবাদত করাই উত্তম। তাহাজ্জুদ যেহেতু একটি নফল ইবাদত, তাই এটি নারীরা ঘরে একাকী আদায় করবেন, এর জন্য জামাতের কোনো প্রয়োজন নেই।
সুবিধা: ঘরে পড়ার কারণে নারীরা তুলনামূলক বেশি সুবিধা ও গোপনীয়তা পান, যা এই ইবাদতের জন্য খুবই সহায়ক।
তাহাজ্জুদ নামাজের প্রস্তুতি
গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ার জন্য সামান্য প্রস্তুতির প্রয়োজন।
দৃঢ় ইচ্ছা: রাতে ঘুমানোর আগেই মনে মনে তাহাজ্জুদের জন্য ওঠার দৃঢ় ইচ্ছা বা নিয়ত করুন।
অ্যালার্ম: প্রয়োজনে মোবাইলে বা ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখুন।
পবিত্রতা: ঘুম থেকে উঠে পবিত্রতার সাথে অযু সম্পন্ন করুন।
উপযুক্ত স্থান: ঘরের একটি শান্ত, পরিষ্কার ও নিরিবিলি স্থান নামাজের জন্য বেছে নিন, যেখানে মনোযোগ भंग হওয়ার সম্ভাবনা কম।
মহিলাদের তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম (ধাপে ধাপে)
অন্যান্য নফল নামাজের মতোই তাহাজ্জুদের নিয়ম অত্যন্ত সহজ।
১. সময়
এশার নামাজের পর থেকে সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত তাহাজ্জুদের সময়। তবে সবচেয়ে উত্তম সময় হলো রাতের শেষ তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ রাত ২টার পর থেকে ফজরের আযানের আগ পর্যন্ত।
২. রাকাত সংখ্যা
সর্বনিম্ন: ২ রাকাত।
উত্তম: ৮ রাকাত। রাসূলুল্লাহ (সা.) সাধারণত ৮ রাকাত পড়তেন।
সামর্থ্য অনুযায়ী: আপনি ২, ৪, ৬, ৮ বা ১২ রাকাত—যেকোনো সংখ্যায় পড়তে পারেন। রাকাত সংখ্যার চেয়ে নামাজের একনিষ্ঠতা ও মনোযোগ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
৩. নিয়ত
মনে মনে ‘আমি দুই রাকাত তাহাজ্জুদের নফল নামাজ পড়ছি’—এই ইচ্ছা পোষণ করাই নিয়ত। মুখে উচ্চারণ করা বাধ্যতামূলক নয়।
৪. নামাজ আদায়ের পদ্ধতি
‘আল্লাহু আকবার’ বলে নামাজ শুরু করুন।
প্রথম রাকাতে সানা, সূরা ফাতিহার সাথে আপনার জানা যেকোনো একটি সূরা (বা কয়েকটি আয়াত) পড়ুন। তাহাজ্জুদে দীর্ঘ ক্বিরাত বা লম্বা সূরা পড়া মুস্তাহাব।
এরপর স্বাভাবিক নামাজের মতো রুকু ও সিজদা করুন। সিজদায় বেশি সময় ধরে তাসবিহ পড়ুন এবং মনে মনে দোয়া করুন।
দ্বিতীয় রাকাতের জন্য উঠে সূরা ফাতিহার সাথে অন্য একটি সূরা পড়ুন এবং নামাজ সম্পন্ন করে সালাম ফিরান।
এভাবে দুই দুই রাকাত করে আপনার নির্ধারিত রাকাত সংখ্যা পূর্ণ করুন।
৫. দোয়া
তাহাজ্জুদের মূল روح হলো দোয়া। নামাজ শেষে হাত তুলে আল্লাহর কাছে আপনার মনের সব কথা বলুন। নিজের জন্য, স্বামী, সন্তান, বাবা-মা এবং পুরো উম্মাহর জন্য দোয়া করুন। এই সময়ে দোয়া কবুল হয়।
মহিলাদের জন্য কিছু বিশেষ প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্ন ১: মাসিক বা পিরিয়ডের সময় কি তাহাজ্জুদ পড়া যাবে?
উত্তর: না, মাসিক অবস্থায় কোনো প্রকার নামাজ (সালাত) পড়া জায়েজ নেই। তবে আপনি এই সময়ে তাহাজ্জুদের সওয়াব থেকে বঞ্চিত হবেন না। রাতের ওই সময়ে ঘুম থেকে উঠে, অযু করে নির্দিষ্ট জায়গায় বসে আপনি তাসবিহ (সুবহানাল্লাহ), তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), দরুদ শরিফ পাঠ করতে পারেন এবং আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে দোয়া করতে পারেন। এর মাধ্যমেও আপনি তাহাজ্জুদের আধ্যাত্মিকতা ও সওয়াব লাভ করবেন, ইনশাআল্লাহ।
প্রশ্ন ২: ঘরোয়া কাজ ও সন্তানদের সামলে কিভাবে তাহাজ্জুদ পড়ব?
উত্তর: আল্লাহ আপনার পরিস্থিতি সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানেন। আপনাকে ৮-১২ রাকাত পড়তে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আপনি যদি সন্তানদের বা পরিবারের দায়িত্বের কারণে ক্লান্ত থাকেন, তবে শুধু দুই রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। আপনার এই ত্যাগ ও সামান্য চেষ্টাই আল্লাহর কাছে অনেক বড়।
আপনার জন্য একটি বার্তা
একজন নারী হিসেবে আপনার কাঁধে হয়তো স্ত্রী, মা, কন্যা বা কর্মজীবীর বহু দায়িত্ব। এই সমস্ত দায়িত্ব পালনের পর রাতের গভীরে আরামের ঘুম ত্যাগ করে আল্লাহর জন্য দাঁড়ানো— নিঃসন্দেহে একটি বিশাল ত্যাগের কাজ।
বিশ্বাস করুন, আপনার এই রাতের নীরব প্রার্থনাগুলোই হয়তো আপনার এবং আপনার পরিবারের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্যের চাবিকাঠি হয়ে উঠবে। তাই হতাশ না হয়ে আজ রাত থেকেই শুরু করুন, দুটি রাকাত দিয়ে হলেও। আল্লাহ আপনার প্রতিটি চেষ্টাকে কবুল করুন। আমিন।
Comments
Post a Comment