ফজরের নামাজের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়টুকু দিনের সবচেয়ে শান্ত, স্নিগ্ধ এবং বরকতময় মুহূর্ত। এটি এমন এক বিশেষ সময় যখন মহান আল্লাহ তাআলার রহমত ও বরকত পৃথিবীতে নেমে আসে। এই সময়কে যারা ইবাদত, জিকির এবং দোয়ার মাধ্যমে কাজে লাগায়, তাদের রিজিক ও সারা দিনের কাজে আল্লাহ বরকত দান করেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এই সময়টাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। দিনের শুরুতে আল্লাহর স্মরণে দিন শুরু করলে মন যেমন প্রশান্ত থাকে, তেমনি সকল বিপদ ও শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। চলুন, জেনে নেওয়া যাক এই মূল্যবান সময়ে আমরা কোন আমলগুলো করতে পারি।
১. আয়াতুল কুরসি পাঠ: শয়তান থেকে সুরক্ষার দুর্গ
ফজরের পর অন্যতম সেরা আমল হলো আয়াতুল কুরসি পাঠ করা। হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি সকালে আয়াতুল কুরসি পড়বে, সে বিকেল পর্যন্ত জিন ও শয়তানের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর আশ্রয়ে থাকবে। এটি যেন মুমিনের জন্য একটি ঐশী বর্ম।
আয়াতুল কুরসি
আরবি: ٱللَّهُ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلْحَىُّ ٱلْقَيُّومُ ۚ لَا تَأْخُذُهُۥ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ ۚ لَّهُۥ مَا فِى ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِى ٱلْأَرْضِ ۗ مَن ذَا ٱلَّذِى يَشْفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذْنِهِۦ ۚ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ ۖ وَل
َا يُحِيطُونَ بِشَىْءٍ مِّنْ عِلْمِهِۦٓ إِلَّا بِمَا شَآءَ ۚ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَ ۖ وَلَا يَـُٔودُهُۥ حِفْظُهُمَا ۚ وَهُوَ ٱلْعَلِىُّ ٱلْعَظِيمُ বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল ক্বাইয়্যুম। লা তা’খুযুহু সিনাতুঁ ওয়ালা নাঊম। লাহূ মা ফিস্ সামাওয়াতি ওয়ামা ফিল আরদ্বি। মান যাল্লাযী ইয়াশফাউ’ ই’ন্দাহূ ইল্লা বিইজনিহি। ইয়া’লামু মা বাইনা আইদীহিম ওয়ামা খলফাহুম, ওয়ালা ইউহিতূনা বিশাইয়্যিম্ মিন ‘ইলমিহি ইল্লা বিমা শা-আ’ ওয়াসিআ’ কুরসিইয়্যুহুস্ সামাওয়াতি ওয়াল আরদ্বি, ওয়ালা ইয়াউ’দুহূ হিফযুহুমা ওয়া হুওয়াল আলিইয়্যুল আজীম।
অর্থ: আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। তিনি চিরঞ্জীব ও বিশ্বচরাচরের ধারক। তন্দ্রা বা নিদ্রা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সবকিছু তাঁরই মালিকানাধীন। তাঁর হুকুম ব্যতীত এমন কে আছে যে তাঁর কাছে সুপারিশ করতে পারে? তাদের সম্মুখে ও পেছনে যা কিছু আছে সবকিছুই তিনি জানেন। তাঁর জ্ঞানভান্ডার থেকে তারা কিছুই আয়ত্ত করতে পারে না, কেবল যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত। তাঁর আসন (কুরসি) সমগ্র আসমান ও জমিন পরিবেষ্টন করে আছে। আর সেগুলোর তত্ত্বাবধান তাঁকে মোটেই ক্লান্ত করে না। তিনি সর্বোচ্চ ও মহান। (সূরা বাকারা: ২৫৫)
২. কুরআন তিলাওয়াত: আল্লাহর সাথে কথোপকথন
ফজরের পর স্নিগ্ধ ও শান্ত পরিবেশে কুরআন তিলাওয়াত করার মাধ্যমে সরাসরি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন হয়। এই সময়ে মন সবচেয়ে বেশি উন্মুক্ত থাকে, ফলে কুরআনের বাণী অন্তরে প্রবেশ করে এবং সারাদিনের জন্য পাথেয় হয়ে থাকে। প্রতিদিন অল্প কিছু আয়াত হলেও বুঝে পড়ার চেষ্টা করুন।
৩. জিকির ও তাসবিহ পাঠ: অন্তরের প্রশান্তি
জিকির হলো আল্লাহর স্মরণ। ফজরের পর জিকির ও তাসবিহ পাঠে আত্মা প্রশান্ত হয় এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। কিছু ফজিলতপূর্ণ জিকির হলো:
সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি, আস্তাগফিরুল্লাহ।(১০০ বার)অর্থ: আমি আল্লাহর প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা করছি এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। রাসূল (সা.) প্রতিদিন ফজরের পর জায়নামাজে বসেই এই জিকির করতেন।
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু, ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাই'ইন কাদির।(১০ বার)অর্থ: আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই, তিনি এক, তাঁর কোনো অংশীদার নেই। রাজত্ব তাঁরই, সমস্ত প্রশংসাও তাঁর। আর তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।
নামাজের পরের তাসবিহ: (সুবহানাল্লাহ ৩৩ বার, আলহামদুলিল্লাহ ৩৩ বার, আল্লাহু আকবার ৩৩ বার, এবং শেষে ১ বার উপরের দোয়াটি)।
৪. দোয়া করা: কবুল হওয়ার বিশেষ মুহূর্তে
ফজরের সময়টি দোয়া কবুলের অন্যতম সেরা সময়। এই সময়ে নিজের, পরিবারের, মুসলিম উম্মাহর এবং দুনিয়া-আখিরাতের কল্যাণের জন্য কায়মনোবাক্যে দোয়া করুন। কিছু মাসনুন দোয়া নিচে দেওয়া হলো:
হাসবিয়াল্লা-হু লা ইলা-হা ইল্লা হুয়া, ‘আলাইহি তাওয়াক্কালতু, ওয়াহুয়া রব্বুল আরশিল আজিম।(৭ বার)অর্থ: আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি ছাড়া কোনো হক্ব উপাস্য নেই। আমি তাঁর উপরই ভরসা করি, আর তিনি মহান আরশের রব। (আবু দাউদ)
আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফি'আ, ওয়া রিযকান ত্বইয়িবা, ওয়া আমালান মুতাক্বাব্বালা।অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে উপকারী জ্ঞান, পবিত্র রিজিক এবং কবুলযোগ্য আমল প্রার্থনা করছি।
রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও, ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাও, ওয়াক্বিনা আ'যাবান্নার।অর্থ: হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন এবং আখেরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।
৫. ইশরাকের নামাজ আদায়
ফজরের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত জিকির-আজকার করে সূর্য পুরোপুরি ওঠার প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর দুই রাকাত ইশরাকের নামাজ আদায় করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। হাদিসে এই আমলের বিনিময়ে একটি পূর্ণাঙ্গ হজ ও ওমরার সওয়াব পাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
শেষ কথা
ফজরের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়টুকু অবহেলায় না কাটিয়ে আল্লাহর ইবাদতে ব্যয় করা একজন মুমিনের জন্য অত্যন্ত বুদ্ধিমানের কাজ। এই সময়টুকু আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গভীর করার এক সুবর্ণ সুযোগ। আসুন, আমরা প্রতিদিন এই আমলগুলো করার মাধ্যমে আমাদের দিনকে বরকতময় এবং সফল করে তুলি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফিক দান করুন। আমিন।
Comments
Post a Comment