-->

অপ্রথম পিরিয়ড বা মাসিকের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

অপ্রথম পিরিয়ড বা মাসিকের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

 

আমি ছোটবেলার থেকেই গোয়েন্দাপ্রবর-গোছের ছিলাম। এমন কিছু ছিল না যেই বিষয়ে আমার আগ্রহ ছিল না। কেউ আমাকে কিছু না বলে এড়িয়ে বা লুকিয়ে গেলে আমার ভয়ানক রাগ হত, আর আমি যেনতেনপ্রকারেণ সেই রহস্য উদ্ঘাটন করতে নেমে যেতাম। তাই, ছোটবেলার থেকেই sanitary napkin বিষয়ে ঢাক-ঢাক-গুড়-গুড়, আমার এক মাসির রজঃনিবৃত্তি-পরবর্তী রক্তস্রাবের কারণে অস্ত্রোপচার করানো ও সেই সব বৃত্তান্ত আমি ঘরে ঢুকলেই চাপা দিয়ে দেওয়া — এই সব আমাকে ভিতরে ভিতরে খেপিয়ে তুলেছিল👿। তার উপরে, আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি, আমার মাসতুতো দাদা তখন দশম শ্রেণী উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় মাসি তার সমস্ত বইপত্র আমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন। আমি পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সেই সব বই বসে বসে পড়েও ফেলেছিলাম। এ ছাড়াও পঞ্চম শ্রেণীতে যখন সহপাঠিনীরা একে একে ঋতুমতী হচ্ছে, তখন আমাদের একাধিক শিক্ষিকা একাধিক বার এই বিষয়ে do's-and-don'ts বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তাই রজঃস্রাবের কী-কেন-কবে সবকিছুর বিষয়ে একটা গড় ধারণা আমার মাথায় আগের থেকেই ছিল(আমার মা কেন এই আবশ্যক দায়িত্বটা পালন করেননি তা আমার কাছে এখনও রহস্য, তবে তিনি কিঞ্চিৎ 'ওইরকম'ই, আজ পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সেও তাঁর নিজের কয়েক দশক আগে ঘটে যাওয়া গর্ভপাতের কথা বলতে যেন গলা বুজে আসে)।

এ হেন আমার কাছে রজঃদর্শন কোনো অবাক-আশ্চর্য-ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়ে যে আসবে না, তাতে আর সন্দেহ কি আছে? তা সত্ত্বেও সেই সাতাশে মার্চ ২০০৭ সালে, ষষ্ঠ শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পরে ও নিজের দ্বাদশতম জন্মদিনের সপ্তাহ-দুয়েক আগে মনের সুখে বসে বসে TVতে 'Goosebumps' দেখতে দেখতে যখন তলপেটে অস্বস্তি অনুভব করে toiletএ গিয়ে আমি আবিষ্কার করলাম যে আমারও 'হয়ে গেছে' তখন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল — মা কে বলব কী করে? কী ভাষা ব্যবহার করব? রক্তটা যেই জায়গা দিয়ে বইছে তার কোনো চলতি বাংলা প্রতিশব্দই তো কোনোদিন কারও মুখে শুনিনি(তখনও অবধি)! আমি আগেভাগেই সব জানি জানলে মা 'পাকামি'র কারণে বকবেন না তো? যথাসম্ভব নিরীহ ভাবে কী করে ব্যাপারটা প্রকাশ করা যায়?

কিন্তু হা হতোস্মি, এই চরম মুহূর্তে এসে আমার মস্তিষ্কও চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা করল, শত উদ্ভাবনী শক্তি খাটিয়েও মাথার থেকে কিছুই বার করতে পারলাম না😑। তাই অসীম সাহসী বীরাঙ্গনা আমি ঠিক করলাম যে আমি এই ভাবেই থাকব, কোনো napkinএর দরকার নেই আমার😎। হ্যাঁ, পশ্চিমী ন্যাকা-নারীবাদীদের অনেক আগেই আমি এই তথাকথিত 'free bleeding'এর বিপ্লব এনেছিলাম বলতে পারেন(আমি নারীবাদের বিপক্ষে নই, তবে 'free bleeding' ব্যাপারটায় আদৌ কোনো নারীর স্বার্থরক্ষা হয় না, উল্টো ক্ষতি হতে পারে)। সেই ভাবেই আমি 'শ্রীলেদার্স'-এ গেলাম জন্মদিনের জুতো কিনতে, সেই ভাবেই সপরিবারে restaurantএ খেতেও গেলাম, সেই ভাবেই চার-পাঁচদিন কাটিয়ে দিলাম। তার পরে একদিন যখন ভাতঘুম দিয়ে উঠে চুপিচুপি নিজের নিম্নাঙ্গ পরীক্ষা করে দেখছি রক্তস্রাব বন্ধ হল কি না…তখনই, ঠিক তখনই মায়ের কাছে ধরা পড়ে গেলাম। মা হঠাৎ করেই ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে বললেন, "কী হয়েছে রে? ওখানে কী করছিস?" আমি কোনোমতে বললাম, "রক্ত"। তখন মা toiletএ নিয়ে গিয়ে ভালো করে পরীক্ষা করে বললেন, "পিরিয়ড হয়েছে।" আমি যথাসম্ভব নিরীহ মুখ করে জিজ্ঞাসা করলাম, "কী?" মা বললেন, "পিরিয়ড। দাঁড়াও প্যাড আনি।" বলে অন্য ঘর থেকে sanitary napkin আনতে গেলেন। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম; এত বড় গোপনীয়তা বয়ে বেড়ানোটা সত্যিই বিরক্তিকর হয়ে যাচ্ছিল আমার পক্ষে☹️। যাই হোক, মা তো sanitary napkin ব্যবহার করার পদ্ধতি দেখিয়েও দিলেন, আমিও ভালোমানুষের মত মুখ করে 'শিখে' নিলাম। শেষে মা বললেন, "এখন থেকে প্রতি মাসে এই রকম হবে, পঁয়তাল্লিশ-আটচল্লিশ বছর বয়স অবধি; এখন থেকে তুমি বড় হয়ে গিয়েছ; কেন, বন্ধুদের কারও হয়নি, ওরা এসে স্কুলে বলে না? আর শোনো, ভাইকে যেন এই সব কথা বলো না!🤫🤐" যাব্বাবা😳😱😨😰😢😥😓! তার মানে 'আগেভাগে' জানার জন্য আদৌ আমি বকা খেতাম না? তার মানে আমার এত সব জল্পনা-কল্পনা-পরিকল্পনা সব বৃথা? লে হালুয়া!😒

'আসলি খেল' তো শুরু হল তার পরে — প্রাকৃতিক নিয়মানুযায়ী প্রথম বছর খানেক ধরে অনিয়মিত ও দীর্ঘ দিন ধরে চলা রজঃস্রাব, পুজোর সময়ে রজঃস্রাব, বেড়াতে গিয়ে রজঃস্রাব, পরীক্ষার সময়ে রজঃস্রাব 😐😵🙄। আগেই বলেছি যে আমার মা কিঞ্চিৎ 'ওইরকম', তাই তাঁর ধমকে কয়েক বছর খাটের গদির নিচে sanitary napkinএর packet লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হওয়ার পরে একদিন 'ধুত্তোর' বলে bathroomএর তাকে রাখতে শুরু করাও চলল। তখন মায়ের ভয়ে রজঃস্রাব বন্ধ হলেই মাথায় shampoo ঘষে স্নান করতে হত, কয়েক বছর পর থেকে আমার যখন ইচ্ছা শুধু মাত্র তখন মাথায় shampoo লাগাই(রজঃস্রাবের রক্ত আর কিছু মাথায় লেগে থাকে না যে রজঃস্রাব বন্ধ হলেই মাথা ঘষে স্নান করতে হবে😕)। মা নিজের সেই জড়তার কারণেই আমাকে কখনও বাহুমূলের কেশ বা যৌনকেশ shave করার কথা বলেননি, যত দিন না আমার ত্বকে ছত্রাকজনিত সংক্রমণের কারণে প্রচণ্ড চুলকানি হতে থাকে ততদিন অবধি, এমন কি তার পরে, অর্থাৎ সংক্রমণ সেরে যাওয়ার পরেও আমাকে উপযুক্ত razor দেওয়া হয়নি, প্রয়োজনে বাবার shaving kit থেকে গোপনে সরানো bladeএর উপর নির্ভর করতে হত আমাকে😖🥴(যদিও এটা সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক বিষয়; পরিচ্ছন্ন থাকতে হলে যে শরীরের সমস্ত লোম তুলে ফেলতে হবে তার কোনও মানে নেই)। আর, মায়ের 'ওইরকম'-পনার জন্য আরও একটা খেসারত আমাকে দিতে হয়েছিল : ততদিনে প্রাকৃতিক নিয়মেই ঊর্ধ্বাঙ্গ যথাযথভাবে উন্নত হয়ে গেলেও আমাকে শুধু camisole পরতে হত, কারণ তাঁর ধারণা ছিল যে আমার convent schoolএর রক্ষণশীল খৃষ্টান সন্ন্যাসিনী sisterরা ছাত্রীদের 'bra' পরা পছন্দ করবেন না(সিস্টাররা কি ছাত্রীদের অন্তর্বাস পরীক্ষা করতে আসছেন? আজব তো!)। ফলে ধীরে ধীরে আমি শরীর ঘিরে সঙ্কোচে ও চলাফেরার অসুবিধার কারণে প্রায় স্থাণুবৎ হয়ে যেতে থাকি। এখানেও পরিত্রাতা সেই মাসিরাই; এক দিন তাঁরাই বিষয়টি লক্ষ্য করে আমার মাকে ডেকে এই বিষয়ে বুঝিয়ে বলেন, এবং আমিও যথাযথ অন্তর্বাস পরতে পেয়ে বাঁচলাম😝!

এত সব কিছু কেন লিখলাম?

  • হয়তো এটা বোঝাতে যে সদ্য রজঃদর্শন ঘটা কিশোরীও আদতে একটি শিশুই, তার মনোবৃত্তি শিশুসুলভই হওয়ার কথা, তাই তাকে আগে থেকে বয়ঃসন্ধি সম্পর্কে সতর্ক করে না দিলে বা পরিবারে এই বিষয়ে অহেতুক গোপনীয়তার সংস্কৃতি বজায় রাখলে সে তার শিশুসুলভ বুদ্ধি দিয়ে এমন কিছুও করে বসতে পারে তা আখেরে তার জন্য ক্ষতিকারক। যেমন, লজ্জা-ভয়-সঙ্কোচকে অবলম্বন করে থেকে আর কিছু দিন 'free bleeding' চালালে জননপথে মারণ সংক্রমণ আমার হতেই পারত, হয়তো আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা আমাকে শেষ অবধি বাঁচিয়ে তুললেও, অন্ততপক্ষে যমে-মানুষে টানাটানি তো হতই।
  • হয়তো এটা বোঝাতে যে কোনো শিশুরই তার অভিভাবকদের কাছে কোনোকিছু বলতে দ্বিধাবোধ করা উচিৎ নয়, বিশেষতঃ কোনও কিছুর বিষয়ে জানার থাকলে বা জেনে থাকলে তার জন্য অপরাধবোধে ভোগা কোনো শিশুরই উচিত নয়। শিশুর জন্ম তার অনুমতি নিয়ে দেওয়া হয় না, অতএব এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে গেলে যে স্বাভাবিকভাবেই তাকে সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগেই তথ্য সংগ্রহ করে তা নিজের মস্তিষ্কের দ্বারা process করতে হবে, এটা অভিভাবকদের বোঝা উচিত।
  • হয়তো এটা বোঝাতে যে আমি যদি কখনো কোনো শিশুকন্যার মা হই, তবে তাকে যথাযথ বয়সের আগেই এই বিষয়ে শিক্ষা দেব, তাকে বাড়ন্ত শরীরের উপযোগী অন্তর্বাস পরিধান করাব, এবং অতি অবশ্যই শরীর সম্পর্কে কোনও কুসংস্কার শেখাব না। আমি চাই না যে আমার কোনো সন্তান আমার বর্তমানে(বা অবর্তমানে) নিজেকে অসহায় বা বিপন্ন বোধ করুক।
>